মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম:: পহেলা মে, মহান ‘মে দিবস’। শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক সংহতির দিন। শ্রমিকের বিজয়ের দিন, আনন্দ ও উৎসবের দিন। নতুন সংগ্রামের শপথ নেওয়ার দিন।
‘আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিশ্রাম ও বাকি আট ঘণ্টা বিনোদন ও সংগ্রাম’Ñ এটিই ছিল মে দিবসের মূল সেøাগান। সে সংগ্রাম হলো শোষণ থেকে মুক্তির জন্য, শোষণমুক্ত মানবিক সমাজের জন্য, মুক্ত মানুষের মুক্ত বিশ্ব প্রতিষ্ঠার জন্য, সমাজতান্ত্রিক-সাম্যবাদী সভ্যতা নির্মাণের জন্য সংগ্রাম। অনেক দেশে শ্রমিকদের কাজের সময়ের দাবিটি পরবর্তীকালে আরও অগ্রসর হয়েছে। ‘সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা অথবা ৪২ ঘণ্টার বেশি কাজ নয়’Ñ এভাবে দাবি উঠেছে। সে দাবি আদায়ও হয়েছে। কত ঘণ্টা কাজ করতে হবে নিঃসন্দেহে এটা একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানবিক বিষয়। কিন্তু তার অন্তর্নিহিত মূল কথাটি হলো ‘কাজের সময় কমাতে হবে।’ কারণ ‘বাকি যে ৮ ঘণ্টা বিনোদন ও সংগ্রামের’ জন্য সেটুকুই শুধু শ্রমিকের ‘নিজের সময়’। কাজের সময় কমানো প্রয়োজন যাতে করে শ্রমিক তার ‘নিজের জন্য সময়’ বাড়িয়ে নিয়ে প্রকৃত ‘বাঁচা’ বাঁচতে পারে।’ ইংরেজিতে বললে, ‘ংড় ঃযধঃ যব পধহ ষরাব, নবংরফবং লঁংঃ বধৎহরহম ধ ষরারহম।’
পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকরা কাজ করে জীবিত থাকার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহের জন্য। সে কাজ করে তার শ্রম প্রদানের ক্ষমতা পুনরুৎপাদনের উদ্দেশ্যে। শ্রমশক্তির অব্যাহত পুনরুৎপাদনের জন্য যা অপরিহার্য তা হলো, শ্রমিকের নিজের ও নিজের শ্রমশক্তি এবং শ্রমের অব্যাহত প্রবাহ নিশ্চিতের জন্য বংশবৃদ্ধি করতে, গোটা পরিবারের ভরণ-পোষণ, শিক্ষা-চিকিৎসা, মাথা গোঁজার ঠাঁই ইত্যাদির ব্যবস্থা করা। সেই সঙ্গে শরীর ঠিক রাখার জন্য অপরিহার্য হলো ন্যূনতম ঘুম ও বিশ্রাম। এসবই হলো মানুষের জীবিত থাকার আয়োজনের ব্যাপার। প্রশ্ন হলো, এসব যদি হয় আয়োজনের ব্যাপার মাত্র, তাহলে মানুষ সেই আয়োজনে নিজেকে নিয়োজিত করবে কী উদ্দেশ্যে? নিশ্চয়ই তা হলো, এই আয়োজনের দ্বারা প্রকৃত ‘বেঁচে থাকার’ (ঃড় ষরাব) ব্যবস্থা করার জন্য। পুঁজিবাদী সমাজে কাজ ও বিশ্রামের সময়টুকু হলো জীবিত থাকার আয়োজন মাত্র (ঃড় বধৎহ ধ ষরারহম)। আসল মানব জীবনযাপন বা বাঁচার জন্য সময় রয়েছে কেবল এর বাইরে।
পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সাম্যভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লবী মহাপ-িত কার্ল মার্কস তার ‘ডাস ক্যাপিটাল’ পুস্তকে লিখেছেন, ‘পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাটি (যা কিনা মূলত উদ্বৃত্ত মূল্যের উৎপাদন ও উদ্বৃত্ত শ্রম শুষে নেওয়া) শ্রমিকের কাজের সময়টি বাড়িয়ে দিয়ে মানবিক শ্রমশক্তির স্বাভাবিক, নৈতিক, শারীরিক ক্রিয়াকর্মের ও উন্নতির সম্ভাবনাকে কেড়ে নিয়ে কেবল তার অবনতিই ঘটায় না, এই উৎপাদন ব্যবস্থা মানুষের শ্রমশক্তির অকাল শ্রান্তি-ক্লান্তি-মৃত্যুও ঘটায়। শ্রমিকের প্রকৃত আয়ু কমিয়ে দিয়ে নির্দিষ্টকালের মধ্যে তার উৎপাদনের সময়টি বাড়িয়ে দেয়।’ সুতরাং শারীরিকভাবে জীবিত থাকার প্রয়োজনে একজন শ্রমিককে যে সময় দিতে হয়, তা থেকে প্রকৃত ‘বেঁচে থাকার’ সময়ের ক্ষেত্রটিকে প্রসারিত করার জন্য ‘সম্ভাব্য সবচেয়ে কম সময় কাজ করে জীবিত থাকার ব্যবস্থা করা’Ñ এই মর্মবাণী সম্পন্ন দাবি এক বিরাট ঐতিহাসিক-সামাজিক-রাজনৈতিক তাৎপর্য বহন করে। ‘মে দিবসের’ আট ঘণ্টা কাজের কেন্দ্রিক দাবিটির কালোত্তীর্ণ গুরুত্ব ও তাৎপর্যের একটি প্রধান উৎস এখানেই।
১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগো শহরের শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের মূল দাবি ছিল ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার প্রতিষ্ঠা। ওই কর্মসূচির অংশ হিসেবে সেদিন ৩ লাখ শ্রমিক এক ঐতিহাসিক ধর্মঘটে শামিল হয়েছিল। ২ মে ছিল রোববার। ৩ মে আরও বড় শ্রমিক সমাবেশে মালিকের গু-ারা আক্রমণ চালিয়ে ৬ জন শ্রমিককে হত্যা করেছিল। এর প্রতিবাদে ৪ মে শহরের হে মার্কেট স্কোয়ারের বিশাল সমাবেশে মালিক ও সরকারের সশস্ত্র বাহিনীর নির্বিচার লাঠিচার্জ ও গুলিতে শ্রমিকের রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল হে মার্কেট চত্বর। নিহত হয়েছিল ৪ জন শ্রমিক। কয়েকজন পুলিশও প্রাণ হারিয়েছিল। ৮ জন শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ৫ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।
আমেরিকার শ্রমিকদের এই আন্দোলনের সমর্থনে দেশে দেশে শ্রমিকরা সংহতি আন্দোলন গড়ে তোলে। ফলে মালিকরা বাধ্য হয়ে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবি মেনে নিতে শুরু করে। ১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকী উপলক্ষে ফ্রেডেরিক এঙ্গেলসের নেতৃত্বে প্যারিসে দ্বিতীয় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই বছরই সোস্যালিস্ট লেবার ইন্টারন্যাশনালের সম্মেলনে জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিনের ঘোষণা অনুযায়ী ১৮৯০ সাল থেকে প্রতিবছর ১ মে ‘মে দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এভাবেই আন্তর্জাতিকভাবে মে দিবস পালনের সূচনা হয়। অর্থাৎ মে দিবসের সামগ্রিক ইতিহাস শুরু থেকেই শ্রমিক শ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠা, মুক্তি অর্জন ও আন্তর্জাতিক সংহতির লক্ষ্যে ধারাবাহিক সংগ্রামের ইতিহাস। এটি কখনোই নিছক কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। মে দিবসকে আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বন্দি করার অর্থই হলো শ্রমিক শ্রেণিকে তার মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত সংগ্রাম থেকে বিচ্যুত করার প্রচেষ্টা। শ্রমিক শ্রেণির কাছে মে দিবস হলো নতুন সংগ্রামে উজ্জীবিত হওয়ার শপথের দিন। কারণ সংগ্রাম ছাড়া আর কোনো পথে শ্রমিকের পক্ষে তার ন্যায্য দাবি আদায় করা সম্ভব নয়।
মে দিবস একটি সংগ্রামের নাম। কারণ সংগ্রামের মধ্য দিয়েই এর উদ্ভব। আবার মে দিবস আয়োজনের ব্যাপারটাও আগাগোড়াই ছিল ও আজও হয়ে আছে একটি সংগ্রামের বিষয়। গত প্রায় সোয়াশ বছরের ইতিহাসে মে দিবস উদযাপনের জন্য দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণিকে সংগ্রাম করতে হয়েছে। সইতে হয়েছে নানামাত্রার পুলিশি নির্যাতন, জেল-জুলুম-হুলিয়াসহ দমন-পীড়ন। এখনো বিশ্বব্যাপী কম-বেশি একই পরিস্থিতি বিদ্যমান। আমাদের দেশেও দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মে দিবস উদযাপনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে মে দিবস পালন করাকে কার্যত দেশদ্রোহী কাজ বলে ব্রিটিশ শাসকরা বিবেচনা করত। পাকিস্তান আমলেও মে দিবস পালন করতে হতো অনেক সতর্কভাবে ও লুকিয়ে ছাপিয়ে। ১৯৬৯-৭০ সালের দিকে পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল। প্রকাশ্যে মে দিবসের অনুষ্ঠান হতে শুরু হয়েছিল। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রণাঙ্গনেই আমরা মে দিবসের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম।
স্বাধীনতার পর মে দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে বাধাগুলো শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে মে দিবস রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ দিনটিতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এতে মে দিবস উদযাপনের ক্ষেত্রে অনেকটাই মুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সুতরাং মে দিবস উদযাপনের ক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম অনেকটা পরিমাণেই মুক্তির নবঅধ্যায় রচনা করেছে।
মে দিবস এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে। দিবসটি এখন সরকারি ছুটির দিন। এটি এখন শ্রমিকদের উৎসবের দিনে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর এই দিনে বিভিন্ন সেক্টরের ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলো এবং সেই সঙ্গে সাধারণ শ্রমিকরাও জাঁকজমকপূর্ণভাবে মে দিবসের কর্মসূচি পালন করে। শ্রমিকরা দলে দলে ঢাকঢোল বাজিয়ে, রঙ ছিটিয়ে এসব অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরাও এখন মে দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেন। মে দিবসে ঢাকা শহর আজকাল অনেকটাই শ্রমিকের উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়।
মে দিবস পালনে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার এই আপেক্ষিক মুক্ত পরিবেশ তৈরি হলেও লাখো শহীদের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতার মতোই, ‘মে দিবসের মুক্তি’ও এ দেশে হোঁচট খেয়েছে। এ দেশের শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনগণকে আবার শোষণ-বঞ্চনা-অধিকারহীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে হয়েছে। রাষ্ট্রীয় নীতি থেকে বস্তুত বিতাড়িত হয়েছে মেহনতি মানুষের মুক্তির প্রশ্নটি। শোষণ-বঞ্চনা ও নিপীড়ন থেকে মুক্ত হয়ে প্রতিটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন হলেও আজ পর্যন্ত সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি।
অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার পথে অগ্রসর হতে ১৯৭২-এর সংবিধানে ‘সমাজতন্ত্র’কে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির অন্যতম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু হত্যা, ষড়যন্ত্র, অন্তর্ঘাত ইত্যাদি চালিয়ে দেশকে অল্প সময়ের মধ্যে সে ধারা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ফলে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণি ও জনগণের অধিকার ও কর্তৃত্ব স্বীকার করা হলেও আজ পর্যন্ত তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং জনগণের সম্পদ ও উৎপাদনব্যবস্থার কর্তৃত্ব চলে গেছে লুটেরা শ্রেণির হাতে।
সংবিধানের ১৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদনব্যবস্থা ও বণ্টনপ্রণালিগুলোর মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন দেশের জনগণ।’ ১৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকেÑ কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্ত করা।’ ২০(১) অনুচ্ছেদে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস রচিত কমিউনিস্ট ইশতেহার উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, “কর্ম হইতেছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয় এবং ‘প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতা অনুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’Ñ এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন।”
সংবিধানে এখনো এসব নির্দেশনা বহাল থাকলেও তথাকথিত মুক্তবাজার নীতির নামে ‘উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদনব্যবস্থা ও বণ্টনপ্রণালি’র মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ ‘দেশের জনগণের’ হাত থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। অসংখ্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে তা তুলে দেওয়া হয়েছে মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে। ‘কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশের’ ওপর এখনো চলছে নানামাত্রিক শোষণ-নিপীড়ন। ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে শ্রমিকদের। নারী শ্রমিকদের ওপর চলছে অধিকতর বঞ্চনা ও বৈষম্য।
ফলে শ্রমিক স্বার্থের অনুকূল প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হলেও গত ৪৫ বছরে দেশ সে পথ থেকে বহু দূরে সরে গেছে। মে দিবস উদযাপনের ক্ষেত্রেও এই পশ্চাদপসারণের প্রভাব পড়েছে। মে দিবস এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রদর্শনবাদ, রাজনৈতিক শোডাউন, চাটুকারিতা, নেতা-নেত্রীভজন ইত্যাদির মধ্যে বন্দি হয়ে গেছে। এক কথায়, মে দিবস পরিণত হয়েছে অনেকটাই স্থূল আনুষ্ঠানিকতায়। এই দিনটি যে শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ধারাবাহিকতার অংশ, ক্রমেই সে বিষয়টি ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু ইতিহাসের দিকে নজর দিলেই মে দিবসের মৌলিক সংগ্রামী ও বিপ্লবী চরিত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমেরিকার শিকাগো শহরে সংগঠিত রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সেই ইতিহাসের সূচনা।
নানা জাঁকজমক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে মে দিবস পালিত হলেও বাংলাদেশে এখনো অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৮ ঘণ্টা শ্রমের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নিশ্চিত হয়নি তার ন্যায্য মজুরি। তাদের চাকরির নিশ্চয়তা নেই। নেই কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার থেকে আজও তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বঞ্চিত। শুধু তাই নয়, লাখ লাখ শ্রমিক বেকার জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। পে-কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা ডবল করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, এমপিদের বেতন-ভাতাও দ্বিগুণ করা হয়েছে। কিন্তু ওয়েজ কমিশন করে শ্রমিকের মজুরি সমঅনুপাতে বাড়ানো হয়নি। ‘জাতীয় নিম্নতম মজুরি’ও নির্ধারণ করা হয়নি। গার্মেন্টের একজন শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি ও সর্বোচ্চ বেতনভোগী রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তার আয়ের অনুপাত এখন ১:২৫। অথচ স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এই অনুপাত ১:৬-এর বেশি হওয়া উচিত নয়।
আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে সূচিত মে দিবসের সংগ্রামের ধারা আজ মহামানবের মহামুক্তির প্রবাহে এসে মিলিত হয়েছে। এ সংগ্রাম মানবমুক্তির সংগ্রাম, মুক্তমানবের মুক্ত সভ্যতা নির্মাণের সংগ্রাম। আধুনিক শ্রমিক শ্রেণি সেই কালান্তরের ইতিহাস রচনা করার যোগ্যতা ও ক্ষমতা রাখে। তাকেই সে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সে জন্য তাকে সচেতন, সংগঠিত ও একত্রিত হতে হবে। গড়ে তুলতে হবে নিজস্ব সংগঠন, সচেতনতা, দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক ঐক্য। এই সত্য উপলব্ধি করে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরা যদি শ্রমিক শ্রেণির পাশে এসে অবস্থান নেয়, তাহলেই সেই সম্ভাবনার দ্বার অবারিত হবে। বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরের শ্রমজীবী মানুষ ও বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী সমাজকে মিলিত হতে হবে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের সাধারণ সংগ্রামের ধারায়। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে মে দিবসের সেই বুুলন্দ আওয়াজ আরও উচ্চকিত হোকÑ ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’।